শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০১৬

অনুভুতির খাতা থেকে (০৫ অগাস্ট ২০১৬)

ফাইরোজের ঘুম ভাঙল দুপুর বারটা সতেরতে। এত বেলা করে সে কখনোই উঠেনা। প্রতিদিন সবার আগে উঠে সে। মুখ-হাত ধুয়ে দুকাপ চা বসায়। এক কাপ নিজের জন্য, আরেক কাপ বাবা মোহাম্মদ হোসেন সাহেবের জন্য। মোহাম্মদ হোসেন সাহেবও অনেক ভোরে উঠেন। ড্রইং রুমে খবরের কাগজ হাতে বসেন আর মেয়ের হাতের চায়ের জন্য অপেক্ষা করেন। ফাইরোজ যখন চায়ে পাতা দেয় তখন উঠেন মা রশীদা আখতার। তিনি চা খাননা। শোবার ঘর থেকে বের হয়ে চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে ফাইরোজ কে বলেন, ও! তুই উঠেছিস, মা? ফাইরোজ কোন কথা বলেনা। সকাল বেলা কথা কম বলতে ভাল লাগে। সে চায়ে চিনি দেয় গুনে গুনে তিন চামুচ।
কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পুর্ণ ভিন্ন। সে ভর দুপুর নাগাদ ঘুমাচ্ছে অথচ তাকে কেউ কিছু বলছেনা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পিঠ ব্যাথা করছে। আশ্চর্য! মা তাকে ডাকলেননা কেন? উঠে বসতেই ফাইরোজের কাশি শুরু হল। ৩-৪ বার কেশেই শেষ। এই ৩-৪ বার কাশিতেই তার গলা ব্যাথা হয়ে গেছে। গলার নিচে বুকের উপরটা জ্বলছে। সে বুকে হাত চেপে ভ্রু কুঁচকে কি যেন বলতে চাইল। একি! খাটের নিচে হাঁস ডাকছে নাকি? ফাইরোজ চমকে উঠল। হাঁস ডাকছে না। তার গলা বসে গেছে। সে আরেকবার মাকে ডাকার চেস্টা করল। লাভ হলনা। গলা দিয়ে হাঁসের মত প্যাক প্যাক আওয়াজ বেরুচ্ছে। মুখ-হাত ধুয়ে সে রুম থেকে বেরুল।
বের হয়েই সে লক্ষ করল আজ ঘরে কেমন যেন উত্‍সব উত্‍সব ভাব। মোহাম্মদ হোসেন সাহেবকে দেখা গেল ইস্ত্রি করা কড়কড়ে পাঞ্জাবী পড়ে সোফায় বসে পান খাচ্ছেন। ব্যাপারটা কী? জুনায়েদ কে দেখা গেল নিজের রুম থেকে ছুটে বেরুচ্ছে। জুনায়েদ ফাইরোজের ছোট ভাই। ফাইরোজ কে দেখে সে দাড়িয়ে গেল। ফাইরোজ বলল, প্যাক প্যাক প্যাক।
ইখতিয়ার কিছুক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। তারপরেই হা হা করে হাসতে শুরু করল। ঘরে মেহমান এসেছে কিনা এটা জানতে চাওয়া কি খুব হাস্যকর কোন ব্যাপার? বেকুবটা হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরেছে কেন? ফাইরোজের ইচ্ছে করল কান টেনে মুচড়ে দেয়। তা হলনা। ইখতিয়ারের হাসির শব্দে রান্নাঘর থেকে রশীদা আখতার ছুটে এসেছেন। ফাইরোজকে দেখে বললেন,ও! তুই উঠেছিস, মা? ফাইরোজ দেখল উত্তরা থেকে তার বড় আপাও এসেছে। পাশে দেখা গেল দুলাভাই। তার মুখটাও হাসি হাসি। চোখে রহস্য। তিনি মাথা দুলিয়ে বললেন, কী শ্যালিকা, ঘুম ভাঙল?
দুলাভাইর সামনে হাঁসের মত প্যাকপ্যাকে গলায় কথা বলার কোন মানে হয়না। সে হনহন করে তার রুমে ফিরে এল। পেছন পেছন এলেন রশীদা আখতার। তিনি মেয়ের পাশে বসলেন, মাথায় হাত রাখলেন। মেয়ের অভিমানী চেহারার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ দুপুরে তোকে দেখতে আসবে। তোর বাবার বন্ধুর ছেলে। ভাল চাকরী করে। রাজপুত্রের মত দেখতে।
ফাইরোজ বলল, প্যাক প্যাক প্যাক।
ধুর বোকা মেয়ে! মেয়ে মানুষ বিয়ে করবিনা তাই কি হয় নাকি! তাছাড়া দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছেনা!
প্যাক প্যাক প্যাক প্যাক!
লক্ষী মা আমার, মন খারাপ করিসনা। যা। বাথরুমে তোর গোসলের পানি, টাওয়েল, একটা নতুন সাবান সব দিয়ে এসেছি। আর শোন, আমার নীল শাড়িটা পরিস। বাথরুমে সব রাখা আছে।
কি আশ্চর্য! মা তার সব কথা বুঝতে পারছে! ইখতিয়ার কেন বুঝলনা? মা-রা সব বুঝেন। ফাইরোজ মিন মিন করে বলল, প্যাক প্যাক।
রশীদা আখতার মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে উঠে গেলেন। তিনি জানেন আজই বিয়ে পড়ানো হয়ে যাবে। ছেলেপক্ষের অপছন্দ হবার কোন কারন নেই। সৃষ্টিকর্তা তার মেয়েকে ঐশ্বরিক রূপ আর যৌবন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। অথচ এইতো সেদিন ছোট ছোট পায়ে মেয়েটা ঘরময় হেঁটে বেড়াত। মাথায় লাল রবার ব্যান্ডের এক ঝুঁটি। হাসলে নিচের পাটির দুটি মাত্র দাঁত দেখা যেত। রশীদা আখতারের চোখে পানি চলে আসছে। বিয়োগের কষ্ট মেশানো অতি সুখের এ অশ্রু তিনি কাউকে দেখাতে চাননা।

ফাইরোজ গোসল সেরে বের হয়েছে। তার ঈশত্‍ ভেচা চুল বাম কাঁধের উপর দিয়ে বুকের উপর এসে পড়েছে। পরনে নীল সিল্কের শাড়ি। পাড়ে সোনালী কাজ করা। শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লাউজ। ব্লাউজের হাতায়ও সোনালী কাজ। সে দাড়িয়ে আছে বারান্দার রেলিঙে হেলান দিয়ে। বারান্দার সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফাইরোজের খুব প্রিয়। এই গাছ তার সাথেই বড় হয়েছে। ছোট বেলায় খেলেছে এই গাছের নিচে। কেটেছে কিশোরীকাল। কিছুদিন আগেও সে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো এই গাছের নিচে। তারা কথা বলত চোখের আর হাতের ইশারায়। কেটে যেত সারাটা বিকেল। আজ গাছটা একা। আরো একা হয়ে যাবে।
আগুনলাল কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে ফাইরোজ এখন কি ভাবছে তা আমরা জানিনা। তার ভেজা চুলে সোনালী রোদ পড়ে চিকচিক করছে। চোখে কাজল। মুখে এসে পড়ছে কৃষ্ণচূড়ার লালচে আভা। কী সুন্দরই না তাকে লাগছে!!

-Sharzil Ahamed

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন